ড্রাগণ ফ্রুট কি? ড্রাগন ফ্রুটের চাষ কিভাবে করতে হয়? ড্রাগন ফ্রুটের চাষ করে কিভাবে টাকা ইনকাম করা যায়? এই বিষয়ে আজকে আমরা বিস্তারিত জানবো। ইউটিউবে অথবা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ড্রাগন ফলের চাষ এবং তা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করার কথা আপনি হয়তো শুনেছেন। কিন্তু এই ড্রাগন ফুট এর চাষের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আজকে আমরা জানবো।
সঠিক পদ্ধতিতে ড্রাগন ফ্রুটের চাষ করে আপনিও প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করতে পারেন। তবে ড্রাগন ফলের চাষ করার আগে এর চাষের পদ্ধতি অন্যান্য বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার।
ড্রাগন ফ্রুট কোথাকার ফল? কোথায় প্রথম এর উৎপাদন শুরু হয়েছিল অর্থাৎ ড্রাগন ফ্রুটের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা চলুন প্রথমে একটু জেনে নিই।
ড্রাগন ফ্রুট এর ইতিহাস
ড্রাগণ ফ্রুট ভারতের ফল নয়। ড্রাগন ফ্রুট প্রথমে সাউথ আমেরিকা তে পাওয়া গিয়েছিল। তবে তখন ব্যবসায়িকভাবে এর চাষ আবাদ শুরু হয়েছিল না।
এটি একটি ক্যাকটাস জাতীয় উদ্ভিদ যার ব্যবসায়ীক চাষ শুরু হয়েছিল ভিয়েতনামে। প্রথমদিকে বাড়িতে সাজসজ্জা হিসাবে ড্রাগন ফ্রুটের গাছ লাগানো হতো। তবে এর ফলের খুবই সুস্বাদু হওয়ার কারণে বড়ো আকারে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করা হয়।
তারপর ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীব্যাপী এটি ছড়িয়ে পড়ে। এখন আমাদের দেশ ভারত এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্য গুলিতেও ড্রাগন ফ্রুটের ব্যবসায়িক চাষ শুরু হয়েছে।
ড্রাগন ফ্রুটের চাষ
ড্রাগন ফ্রুট সাধারণত ফলের জন্যই চাষ করা হয়ে থাকে। আমেরিকার এই ফল ইজরায়েল, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বেশি মাত্রায় চাষ করা হয়। ড্রাগন ফ্রুট খাদ্য হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত করা হয়। তাছাড়া জ্যাম, জেলি, আইসক্রিম ইত্যাদি তৈরি করার জন্য ড্রাগণ ফ্রুট ব্যবহার হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল ইত্যাদি রোগ নিয়ন্ত্রণ এই ফল দারুণভাবে উপকারী। যে কারণে এই ফলের চাহিদা ভারতে দিনের দিন বেড়েই চলেছে। আপনিও যদি ড্রাগন ফ্রুটের চাষ সম্পর্কে এবং এথেকে কিভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করা যায় তা জানতে চান তাহলে আমাদের সম্পূর্ণ লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন, আশা করি বুঝতে পারবেন।
ড্রাগন ফ্রুট এর উপযোগিতা
ড্রাগন ফ্রুটের এমন কিছু বিশেষত্ব গুন আছে যা মানুষের বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে থাকে। যদিও এটি রোগকে নির্মূল করতে পারেনা তবে বেশ কিছু রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। চলুন এইবার আমরা ড্রাগন ফ্রুটের বিভিন্ন গুনাগুন গুলি সম্পর্কে জেনে নেই।
ডায়াবেটিস রোগে উপযোগী
ড্রাগন ফ্রুটের মধ্যে ন্যাচারাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফেনোলিক অ্যাসিড ফাইবার এবং এসকরবিক অ্যাসিড পর্যাপ্ত মাত্রা রয়েছে। যে কারণে এই ফল ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে লাভ দায়ক। যেসমস্ত লোকেরা ডায়াবেটিস বা মধুমেহ সমস্যা ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে এই ফল উপকারী। শুধু তাই নয় একজন সুস্থ মানুষ এই ফল খেলে তাদের ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কম থাকে।
হার্টের সমস্যায় লাভ দায়ক
হার্টের সমস্যায় ড্রাগন ফ্রুট বেশ উপকারি। বিশেষ করে যারা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর শিকার তাদের ক্ষেত্রে এই ফল খাওয়া অধিক জরুরি। হার্টের রোগের ঝুকি কমাতে সাহায্য করে এই ফল।
ক্যান্সারের রোগে উপকারি
ড্রাগন ফ্রুটে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি টিউমার বেশ ভালো মাত্রায় রয়েছে। কয়েকটি রিসার্চে জানা গেছে যে ড্রাগন ফ্রুটে থাকা গুনাগুন মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কে অনেকটা কমিয়ে দেয়।
কোলেস্টেরলের সমস্যায়
এখনকার সময়ে কোলেস্টেরলের বৃদ্ধি একটি সাধারণ সমস্যা। শরীরে কোলেস্টেরল বাড়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এর মতো বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। ড্রাগন ফ্রুট নিয়মিত খাওয়ার ফলে এই ধরনের সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়।
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে লাভ দায়ক
ডেঙ্গু একটি অত্যন্ত খারাপ রোগ। এই রোগের কারণে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি দুর্বল এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইমিউনিটি কম থাকলে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। ড্রাগন ফ্রুটের মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ গুলিকে খুব দ্রুত কমাতে সাহায্য করে।
ইমিউনিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে উপযোগী
আমাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে ইংরেজিতে ইমিউনিটি বলা হয়। অর্থাৎ যার ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী সে যে কোনো রোগ থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারে। আর এই ইমিউনিটি সিস্টেম আমাদের দৈনন্দিন খাবার-দাবারের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই ড্রাগন ফ্রুট নিয়মিত খেলে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
ড্রাগন ফ্রুট এর বিভিন্ন প্রজাতি
ড্রাগন ফ্রুট চাষ করার আগে এর বিভিন্ন প্রজাতি গুলি সম্পর্কে আমাদের জেনে নেওয়া দরকার। কেননা চাষ, ফলন এবং তা থেকে লাভের পরিমাণ এই প্রজাতির উপরে অনেকাংশেই নির্ভর করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ড্রাগন ফ্রুটের প্রজাতি গুলি নিচে দেওয়া হল।
সাদা ড্রাগন ফ্রুট
আমাদের ভারতে সবথেকে বেশি এই সাদা প্রজাতির ড্রাগণ ফ্রুট চাষ করা হয়ে থাকে। এই ড্রাগণ ফ্রুট খুব সহজেই পাওয়া যায়। সাদা ড্রাগন ফ্রুটের ভিতরের অংশ সাদা রংয়ের হয় এবং এর বীজগুলি কালো রঙের হয়ে থাকে। এই প্রজাতির ড্রাগন ফ্রুটের দাম বাজারে কম।
লাল গোলাপি ড্রাগন ফ্রুট
লাল গোলাপি ড্রাগন ফ্রুট ভারতে কম চাষ হয়ে থাকে। এই ফলের উপরের এবং ভেতরের অংশ গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। খেতে খুবই সুস্বাদু যে কারণে বাজারে এর দাম বেশি।
হলুদ ড্রাগন ফ্রুট
এই হলুদ ড্রাগন ফ্রুট এর উৎপাদন ভারতে খুবই কম। এই গাছগুলিতে যে ফল ধরে সেগুলির বাইরের অংশ হলুদ এবং ভেতরের অংশ সাদা হয়ে থাকে। এটি খেতেও অনেক সুস্বাদু। ভারতের এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম সমস্ত প্রজাতির ড্রাগন ফুট এর থেকে অনেক বেশি।
ড্রাগন ফ্রুট এর জন্য জমি
যেকোনো ধরনের মাটিতেই ড্রাগন ফলের চাষ করা যায়। চাষ করার জন্য উপযুক্ত জল নিকাশি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কেননা জল দাঁড়িয়ে থাকলে গাছের বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ হয়ে থাকে। ড্রাগন ফ্রুটের চাষের ক্ষেত্রে জমির মাটির পিএইচ (PH) মান 6 থেকে 7 এর মধ্যে থাকা দরকার। ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, দিল্লি, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্যে বেশি পরিমাণে ড্রাগন ফ্রুটের চাষ করা হয়ে থাকে। ড্রাগন ফ্রুটের চাষের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্রান্তীয় অর্থাৎ গ্রীষ্মকালীন জলবায়ু অধিক উপযোগী।
ড্রাগন ফ্রুট এর জন্য জমি তৈরি
ড্রাগন ফ্রুটের গাছ লাগানোর আগে জমিকে উপযোগী বানিয়ে নিতে হয়। প্রথমে জমি নির্বাচন করে তাতে সুন্দর ভাবে চাষ করে মাটিকে আলগা করে নিতে হয়। তারপর তাতে জল দিয়ে কাদার প্রলেপ বানাতে হয়। এরপর যদি জমি উঁচু-নিচু থাকে তাহলে সমতল করার দরকার হয়। জমি তৈরি হয়ে গেলে গর্ত খুঁড়ে একটি গর্ত থেকে আরেকটি গড় দূরত্ব 4 ফিট দূরত্ব রাখতে হয়। গর্তের গভীরতা 1.5 ফুট এবং 4 ফুট চওড়া হওয়া দরকার।
জমিতে গর্ত করা হয়ে গেলে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এতে প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক উভয় প্রকার সারের মিশ্রণ করে দেওয়ার দরকার হয়। হিসাব অনুযায়ী, 10 থেকে 15 কেজি গোবর সার এবং তার সাথে 50 থেকে 70 কেজি এনপিকে (NPK) সার কে ভালো করে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়। এরপরে জল সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ড্রাগন ফ্রুট এর জন্য জমিতে সাপোর্টিং সিস্টেম তৈরি
একটি ড্রাগন ফলের গাছ কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে ফলন দিয়ে থাকে। এই ফলের চাষের জন্য জমিতে সাপোর্টিং খুঁটি বসাতে হয়। এতে অধিক খরচ হয়ে যায়। সবথেকে ভালো হয় জমিতে কংক্রিট অর্থাৎ সিমেন্টের খুঁটি তৈরি করা। জমিতে সিমেন্টের 7 থেকে 8 ফুট লম্বা খুটি তৈরি করা হয়। মাটির নিচে দুই থেকে তিন ফুট গভীরতা পর্যন্ত খুটি করলে ভালো হয়। জমিতে খুটি তৈরি হয়ে গেলে সেই খুটির নিচে চারিদিকে ড্রাগন ফ্রুটের গাছ লাগিয়ে দিতে হয়। এই গাছগুলো যখন বড় হয় তখন এগুলিকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেওয়ার দরকার পড়ে।
ড্রাগন ফ্রুট এর জমিতে সেচ
ড্রাগণ ফ্রুট গ্রীষ্মকালীন ফসল হওয়ায় এতে জলসেচের পরিমাণ খুবই কম লাগে। গরমকালে সপ্তাহে একবার এবং শীতকালে প্রতি 15 দিন অন্তর অন্তর জল সেচের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্ষা কালের সময় যদি বৃষ্টিপাত না হয় শুধু সেই সময়ে জলসেচের দরকার পড়ে। গাছের যখন ফুল ধরবে তখন একদমই জল সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। ফুল থেকে যখন ছোটো ছোটো ফল আসতে শুরু করে তখন জমিতে আর্দ্রতা বজায় রাখার প্রয়োজন পড়ে।
ড্রাগন ফ্রুট ফসলের রোগ
ড্রাগন ফ্রুটের গাছের ক্ষেত্রে গুরুতর কোন রোগের দেখা মেলে না। তবে ফসল তোলার আগে গাছের শাখায় পিঁপড়ের আক্রমণের কারণে রস বেরোয় এবং সংক্রমণের সৃষ্টি হয়। নিমের পাতা বা নিম তেলের স্প্রে করলে এ রোগ সহজে সরানো যায়।
ড্রাগন ফ্রুট এর দাম এবং লাভ
প্রতি হেক্টর জমিতে প্রথমবারের ফসলে 400 থেকে 500 কেজি ড্রাগন ফলের উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু গাছের বয়স যখন চার থেকে পাঁচ বছর হয় তখন তার উৎপাদন বেড়ে 10 থেকে 15 টন প্রতি হেক্টরে পৌঁছোয়। ড্রাগন ফুট এর একটি ওজন 500 থেকে 800 গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
যার বাজার মূল্য 200 থেকে 300 টাকা প্রতি কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়। যে কারণে কৃষকরা এর প্রথম ফসলের থেকেই 60 হাজার থেকে 2 লাখ পর্যন্ত সহজেই লাভ করে নিতে পারেন। তবে ভালো বিষয় হচ্ছে, চার থেকে পাঁচ বছর পুরোনো গাছগুলিতে অধিক পরিমাণে ফলন হয়। তখন প্রতিবছর একজন ড্রাগন ফ্রুট চাষী বছরের 30 লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে।
আজকে আপনি কি জানলেন?
আজকে আপনি জানলেন ড্রাগণ ফ্রুট কি? ড্রাগন ফলের চাষ কিভাবে করা যায় এবং ড্রাগন ফুট থেকে মোটামুটি কত টাকা ইনকাম করা যায়। আশা করি আজকের এই ড্রাগন ফ্রুট চাষের বিষয়ে আপনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছেন।
আপনিও যদি আপনার পতিত কোনো জমিকে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করে বা আগে থেকেই চাষযোগ্য জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করতে চান তাহলে খুব তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারেন। কেননা আগামী দিনে এই ফুলের চাহিদা আরো বাড়বে মানুষ।
আগামী দিনে এই ফল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আরো বাড়বে। ভারতের মতো বাজারে এই ড্রাগন ফ্রুটের চাহিদাও রয়েছে। তাই ছোট অংশে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেও লক্ষাধিক টাকা বার্ষিক ইনকাম করতে পারবেন।